বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি
হল পিরামিড। আসলেই আশ্চর্যকর নির্মাণকৌশলসমৃদ্ধ এক স্থাপনা এই পিরামিড। পিরামিড
ও তার নির্মাণশৈলী নিয়ে যুগ যুগ ধরে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। পিরামিডের ভিতরের
দেয়ালে আঁকা নানা রকমের ছবি, চিত্রলিপিতে লেখা ধর্মসংগীত আর দেয়ালে খোদাই
করা প্রাচীন লিপি উদ্ধার করে এ সম্পর্কে সঠিক খবর জানার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি- ঠিক কী কৌশলে তখনকার দিনে সুউচ্চ পিরামিডগুলো তৈরি
করা সম্ভব হয়েছিল। তবে এতটুকু অবশ্যই জানা গেছে যে, পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে এতই নিঁখুতভাবে
এগুলো তৈরি যে একটি পাথর থেকে আরেকটি পাথরের মাঝে এক চুল পরিমাণ ফাঁক নেই। কারো কারো মতে, নির্মাণাধীন পিরামিডের এক পাশ থেকে মাটি বা
পাথরের ঢাল তৈরি করে তার ওপর দিয়ে ভারী পাথর টেনে টেনে তুলে পিরামিড বানানো
হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মত-পিরামিড যত
উঁচু হবে, ঢাল তত প্রশস্ত করতে হবে। এভাবে পিরামিডের চূড়া পর্যন্ত
পৌঁছতে ১৩ মাইল লম্বা ঢাল বানাতে হবে, যা অসম্ভব। আবার আরেক মতানুসারে, পিরামিড
বানানো হয়েছে ধাপে ধাপে চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট ঢাল বানিয়ে। অপর একটি মতে, পিরামিডের
চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করে নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়েছে। পরে মাটি সরিয়ে ফেলা
হয়েছে। বলা বাহুল্য সবকিছুই ধারণা মাত্র। এর প্রকৃত রহস্য অজানা। এর অভ্যন্তরীন নকশাও ছিল দারুণ।
পিরামিডের
অভ্যন্তরীন গঠন-কৌশল
পিরামিড তৈরি করার কারণ
হিসেবে নানারকম কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী
হচ্ছে, প্রাচীনকালে মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, মৃত্যুর
পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। তারা
অনন্ত জীবন নিয়ে সুর্যের প্রহরী হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু যদি তাদের দেহে পচন শুরু হয় বা কোনও আঘাত লাগে
তাহলে তারা অনন্ত জীবন থেকে বঞ্চিত হবেন। তাতে
সুর্য ধ্বংস হবে আর পৃথিবীতে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। তাই মৃত্যুর পর তাদের দেহকে মমি
বানিয়ে পচন রোধ করে নিরাপদ ও দুর্ভেদ্য স্থানে রাখার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল
পিরামিড।
আবার
অনেক ইতিহাসবেত্তাদের মতে, জীবনটাকে যাতে উপভোগ করা যায়, সে
চিন্তায় মিশরীয়রা অস্থির থাকতো। ব্যক্তির গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে গুরুত্ব আরোপ
করা হতো এ ব্যাপারে। ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হতো এ কাজে গুরুত্ব ততো বেশি বেড়ে
যেতো। পরবর্তী জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য স্বভাবতই ফারাওদের ব্যাপারেই পর্যাপ্ত
প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। ক্ষমতায় আসা নতুন ফারাওয়ের প্রথম কাজ সম্পন্ন করা।
প্রত্যেকেই চাইতেন বিশাল আয়তনের হোক তার সমাধিক্ষেত্র। অনেকেই মৃত্যুর আগের দিন
পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যেত। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার
ঘর। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ
বা মৃতদেহ টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা বা ফিরে আসা। এ কারণেই
মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মমি করতো তারা। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য চাই
প্রয়োজনীয় নানা জিনিষ। তাই নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশেষ
করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সাথে দিয়ে দিতো তারা। সমাধিস্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব
ছিলো দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু
কবরে সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের
উদ্দেশ্যেও নির্মাণ করা হতো পিরামিড। তাই ফারাওদের মৃতদেহের সাথে কবরস্থ করা হতো
বিপুল ধন-সম্পদ। সমাজের বিত্তশালীদের কবরেও মূল্যবানসামগ্রী দেয়া হতো। এমনকি, নিন্মশ্রেণীর
মানুষদের কবরেও সামান্য পরিমাণ হলেও কিছু খাবার রেখে দেয়া হতো।
মিশরীয়দের অনুকরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ
পিরামিড তৈরি করলেও মিশরের গীজা শহরের পিরামিড চারটিই বেশি জনপ্রিয়।
রাজার নাম
|
পিরামিডের নাম
|
স্থান
|
উচ্চতা
(মিটার)
|
খুফু
|
দ্য গ্রেট পিরামিড
|
গীজা
|
১৪৬.৬
|
খাফ্রা
|
দ্য খাফ্রা
|
গীজা
|
১৪৩.৫
|
মেনকাউরে
|
পিরামিড অব মেনকাউরে
|
গীজা
|
৬৫.৫
|
হারমাইস
|
স্ফিংস
|
গীজা
|
৭৩.১৫২
|
এই
পিরামিডের জন্য মমি তৈরির প্রক্রিয়াও কিন্তু সহজ ছিলনা!
মমি হলো একটি মৃতদেহ যা জীবের শরীরের নরম
কোষসমষ্টিকে জলবায়ু (বায়ুর
অভাব অথবা অনাবৃষ্টি অথবা মৌসুমীয় অবস্থা) এবং ইচ্ছাকৃত কারণ (বিশেষ দাফন
প্রথাগুলো) থেকে রহ্মা করে। অন্যভাবে বলা যায়, মমি হলো একটি মৃতদেহ যা মানবিক প্রযুক্তির
মধ্যে অথবা প্রাকৃতিকভাবে ধ্বংস এবং হ্ময়প্রাপ্ত হওয়া থেকে রহ্মা করে।
মমি
শব্দটি মধ্যে যুগের লাতিন শব্দ
mumia থেকে
এসেছে, একে পারস্য ফার্সি ভাষা mūm (موم) থেকে আনা হয়েছে যার অর্থ দাহ্য খনিজ পদার্থবিশেষ , অদ্রি (bitumen)।
কোনো মরদেহকে মমি করার জন্য
সবার আগে সেটিকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা প্রয়োজন। সাধারণত
পানির উপস্থিতিতেই ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। সে কারণে মমি করার জন্য মরদেহকে দ্রুত
পানিমুক্ত করা হতো যাতে সেখানে ব্যাকটেরিয়া ভিড়তে না পারে।
মমি
তৈরি করার পদ্ধতিকে মোটামুটি দীর্ঘমেয়াদি বলা চলে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুগন্ধি
কেমিক্যাল দিয়ে একটি দেহ মমি করতে প্রায় ৭০-৮০ দিন লেগে যেত।
*প্রথমে
রাজার শরীর পাম-ওয়াইন ও নীল নদের পানি দিয়ে ধুয়ে শরীরের ভিতর থেকে পচনশীল
দ্রব্য(যেমনঃ হৃৎপিন্ড, ফুসফুস
ইত্যাদি) বের করে ফেলা হত এবং অভ্যন্তরীণ
নাড়ি-ভুঁড়িগুলো বের করে ফেলে দেওয়া হতো। থাকত শুধু চামড়া আর হাড়গোড়। এরপর
পাথর ঢোকানো হত। এরপর লবণ দ্বারা তাদের ঢেকে দেয়া হত যাতে করে শরীরের পানি বেরিয়ে গিয়ে শরীর
শুকিয়ে যায়।
*এরপর
লিনেন নামক কাপড় দ্বারা তাদের শরীরটিকে পেঁচানো হযত ।লিনেন কাপড়কে তারা পবিত্র
কাপড় মনে করত।
*এরপরের
ধাপে মমির দুই হাতের মাঝে একধরনের রক্ষাকারী মন্ত্র লিখে দেওয়া হত। তারা মনে করত
যে এই মন্ত্র তাদের রাজাকে খারাপ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে।
*তারপর
শরীরকে আবার লিনেন দিয়ে মুড়ে বিশেষ ফিতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হত ।
*এরপর শেষধাপে আবার লিনেনে
মুড়ে বুকের উপর ‘আসিরিস’ নামক
দেবতার
প্রতীক
লাগিয়ে দেওয়া হত।
*এভাবে
মমি তৈরি করে তাদের একটি বিশেষ শক্ত ও মজবুত বাক্সে রেখে পিরামিডে স্থাপন করা হত।
মমির
অভিশাপঃ
১৯৯৮
সালের ১৯ অক্টোবরে আমেরিকার "টাইমস" পত্রিকা ছাপিয়েছিল অত্যন্ত রহস্যময় এক কাহিনী।
ল্যুক্সরে (আমেন রা এর সমাধি)
খ্রিস্টপূর্ব
১৫০০ সালের দিকে মারা যান ‘প্রিন্সেস অভ আমেন-রা’। নীলনদের পাশে ল্যুক্সরে তাঁর সৎকার করা হয়। উনিশ শতকের নব্বই শতকের শেষ দিকে চার জন ইংরেজকে ওই রাজকুমারীর মৃতদেহসহ একটি মমি কেনার
জন্য আহ্বান জানানো হয়। উৎসাহী ইংরেজদের একজন বেশ কয়েক হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে বিক্রেতার কাছ থেকে মমিটি কেনেন এবং সেটিকে নিয়ে আসেন তাদের হোটেলে। কয়েক ঘন্টা পর মরুভূমির দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায় ওই ক্রেতা ব্যক্তিকে। তিনি আর কখনও ফিরে আসেন নি।পরেরদিন আরেকজন ইংরেজ এক মিশরীয় ভৃত্য কর্তৃক
গুলিবিদ্ধ হয়ে এমন ভাবে আহত হন যে তার একটি
হাত কেটে ফেলতে হয়।
তৃতীয়
ব্যক্তি দেশে ফিরে আসেন, কিন্তু দেখেন যে, ব্যাংকে গচ্ছিত সমস্ত অর্থ লোপাট হয়ে গেছে
অন্য কারও জালিয়াতির মাধ্যমে।
চতুর্থ
ব্যাক্তি পড়েন প্রচন্ড অসুখে। চাকুরী চলে যায় তার। শেষমেশ তিনি রাস্তায়
দিয়াশলাই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এদিকে
অনেক ঝামেলার পর মমিটি পৌঁছে যায় ইংল্যান্ডে।
কিন্তু
তবু অভিশপ্ত অধ্যায়ের শেষ হয়নি। ওই কফিনের সাথে সর্ম্পকযুক্ত যে কোন মানুষের
ভাগ্যে জুটেছিল দূর্ঘটনা বা মৃত্যু। এমনকী ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য
সংরক্ষিত মমিটির একজন দর্শনার্থীর ভাগ্যেও জুটে চরম দুর্দশা। ওই দর্শনার্থী মহিলা
চরম তাচ্ছিল্যভরে একটি ময়লা পরিষ্কার করার কাপড় দিয়ে মুছেছিলেন কফিনে অঙ্কিত
রাজকুমারীর মুখচ্ছবি। কয়েকদিন পর তার সন্তান মারা যায় হাম রোগে।
মিউজিয়াম
কর্তৃপক্ষ মমিটিকে বেসমেন্টে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সপ্তাহের মাঝেই মমি
সরানোর কাজে অংশগ্রহনকারী একজন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওই কাজের তত্বাবধায়ককে
তার অফিসের ডেস্কের উপর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। স্বভাবতই ব্যাপারটি সংবাদপত্রের
নজরে আসে। একজন ফটো সাংবাদিক ছবি তুলে ডেভেলপ করে দেখতে পান যে, রাজকুমারীর
মুখের বদলে এক বীভৎস চেহারা। জানা যায় যে ওই সাংবাদিক গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
প্রায়
দশ বছর ধরে ঘটতে থাকে এইসব ঘটনা-উপঘটনা। চূড়ান্তভাবে মমিটিকে বিক্রি করা হয় একজন
সৌখিন সংগ্রাহকের কাছে। বিচিত্র রকমের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির পর মমিটিকে তিনি
নির্বাসন দেন নিজ বাড়ীর চিলেকোঠায়। অভিশপ্ত ঘটনার পরও একজন মার্কিন
প্রত্নতত্ববিদ কিনে নেন মিশরীয় রাজকুমারীর মমি। নিউইর্য়কগামী একটি জাহাজে বুক
করেন ওই মমিটি, নিজেও
ওঠেন ওই জাহাজে। বলুন তো জাহাজটির নাম কি?
সেই
জাহাজটির নাম ‘টাইটানিক'
নির্দ্বিধায়
পিরামিড রহস্যের এক বিশাল ভান্ডার। কিন্তু একথাও সত্য যে জ্ঞানই রহস্যের ইতি
ঘটায়। তাই পিরামিড সম্পর্কে জেনে রহস্যময় পিরামিডের রহস্যের ইতি টানার দায়িত্ব
আমাদেরই।